২০১১ সালের ২৪ আগস্ট শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডটির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন টিম কুকের কাছে। এর ছয় সপ্তাহ পরই মারা যান জবস। তখন কুকের সামনে বিশাল দায়িত্বের বোঝা চেপে বসে। জবস ছিলেন একজন স্বাপ্নিক নেতা যিনি ম্যাক, আইফোন, আইপ্যাড, আইপড, আইটিউনস ও অ্যাপ স্টোরের মতো পণ্য বাজারে এনেছেন। জবসের উত্তরসূরি হিসেবে গত ১০ বছরে কী করেছেন, তার সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান মূল্যায়ন করেছে মার্কিন প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট দ্য ভার্জ।
তেল কোম্পানিকে ছাপিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি হওয়া প্রথম প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল। জবসের মৃত্যুর আগেই আগস্টের শুরুতে অল্প সময়ের জন্য এক্সনমবিলকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে দামি কোম্পানি হয়েছিল অ্যাপল। তখন প্রযুক্তি জায়ান্টটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) ও অন্তর্বর্তীকালীন সিইওর দায়িত্ব পালন করছিলেন কুক। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানি আরামকো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে যাত্রার পর অল্প সময়ের জন্য সবচেয়ে দামি কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু গত জুলাইয়ে ২ ট্রিলিয়ন ডলার বাজার মূলধন দিয়ে ফের শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করে অ্যাপল। বর্তমানে প্রযুক্তি জায়ান্টটির বাজার মূলধন আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুই করছে। সৌদি আরামকোর চেয়েও অনেক লাভজনক কোম্পানি অ্যাপল। আর্থিক দিক থেকে গত এক দশকে অ্যাপলকে বেশ শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন কুক। চলতি ছুটির মৌসুমে অ্যাপলের আয় রেকর্ড ১১ হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালে এ মৌসুমে যে আয় হয়েছিল, তার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেড়েছে। ২০১১ সালের প্রথম প্রান্তিকে যেখানে ৬০০ কোটি ডলার মুনাফা হয়েছিল, সেখানে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা চারগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কোটি ডলারে। কোম্পানিটির হাতে বর্তমানে ২০ হাজার কোটি ডলার নগদ অর্থ রয়েছে, ২০১১ সালে যেখানে ছিল ৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। জবস যখন অ্যাপলের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান, তখন কোম্পানিটির কর্মী ছিল ৬০ হাজার ৪০০ জন। বর্তমানে অ্যাপলের ফুলটাইম কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার। গত জুন থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১০ হাজার ডলার মুনাফা করছে অ্যাপল।
আর্থিক দিক থেকে অ্যাপল বেশ শক্তিশালী এটা মেনে নিলেও সমালোচকরা বলছেন, পণ্য উন্মোচনের দিক থেকে কুক এখনো জবসের ধারেকাছেও যেতে পারেননি। প্রযুক্তিবিষয়ক সাংবাদিক ওয়াল্ট মজবার্গ বলেন, টিম কুক নেতৃত্বাধীন অ্যাপল এখনো কোনো গেম-চেঞ্জিং হার্ডওয়্যার পণ্য আনতে পারেনি। জবসের আইফোন, আইপ্যাড ও ম্যাকের মতো বড় কোনো পণ্য উন্মোচন করতে পারেনি কুক নেতৃত্বাধীন অ্যাপল।
বড় উন্মোচন বলতে আইফোনের অ্যাকসেসরিজ যেমন অ্যাপল ওয়াচ ও এয়ারপড। এ পণ্যগুলো আনার ক্ষেত্রে অ্যাপলের বড় কোনো কৃতিত্ব নেই। কারণ এগুলো বাজার থেকে সৃষ্ট চাহিদা। জবস যেখানে গ্রাহকদের মধ্যে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করতে পারতেন, নতুন বাজার তৈরি করতে পারতেন, সেখানে কুক গ্রাহকদের চাহিদার ভিত্তিতে নতুন পণ্য বা সেবা চালু করছেন। জবস যেখানে বড় স্ক্রিনের আইফোনের বিরোধী ছিলেন, সেখানে ২০১৪ সালে আইফোন ৬ প্লাস উন্মোচনের সময় কুকের অভিব্যক্তি ছিল এমন, ভোক্তারা এমনটা চাচ্ছে, আমাদের যেহেতু এটা করার সক্ষমতা রয়েছে, তাহলে তেমনই করছি।
জবস যেখানে সিইওর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অভিনব পণ্য উন্মোচনের স্বাপ্নিক কারিগর ছিলেন সেখানে কুক অনেকটা সিইওর দায়িত্ব পালন করেছেন। কোম্পানিটির আয়েও তার প্রভাব পড়েছে। অ্যাপ স্টোরের মাধ্যমে অ্যাপলের আয় বছরের পর বছর বেড়েছে। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে অ্যাপ স্টোর থেকে ৪৮০ কোটি ডলার আয় করে অ্যাপল। ২০১৭ সালে টানা তিন প্রান্তিকে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করে এবং অ্যাপল ঘোষণা দেয়, অ্যাপ স্টোর সেবা এককভাবে ফরচুন ১০০ কোম্পানিতে জায়গা পেতে সক্ষম। গত প্রান্তিকে অ্যাপ স্টোর থেকে রেকর্ড ১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার আয় করে অ্যাপল, যা আইফোনের আয়ের প্রায় অর্ধেক। আর্থিকভাবে বেশ সবল হলেও বিশ্বব্যাপী নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে অ্যাপল। ভোক্তা, প্রতিদ্বন্দ্বী ও আইনপ্রণেতাদের চাপের মুখে সুনাম খুইয়েছে প্রযুক্তি জায়ান্টটি। গত কয়েক বছরে অ্যাপলকে যতবার জনসমক্ষে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, জবসের পুরো মেয়াদেও তা হয়নি।