দেশটি চতুর্দিকে স্থলভাগ পরিবেষ্টিত হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি দেশ। এর উত্তরে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, পশ্চিমে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা, ভারতের সিক্কিম ও পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৭,৪৪,৫০০। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে দেশটির অবস্থান ১৬৭ তম এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় কম জনসংখ্যার দেশ। দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কায়েম রয়েছে। দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক যিনি ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের পঞ্চম উত্তরাধিকারী এবং ২০০৮ সালে রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হলেন লোটে শেরিং যিনি ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। শেরিং পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং তিনি তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ময়মংসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে।
ভূটানে ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাজতান্ত্রিক দেশ ছিলো। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে তৎকালীন রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুক দেশের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে শুরু করেন যার মাধ্যমে প্রশাসনিক দায়িত্ব শুধু মাত্র রাজার উপর না থেকে বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যক্তির উপর বন্টন করা হবে। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে প্রথমবারের মত ভুটানে জাতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এর সদস্য সংখ্যা ছিলো ১৫১ যারা গ্রামপ্রধান অথবা রাজা এবং দেশটির সরকারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা নির্বাচিত হতো। ১৯৭২ সালে রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুক এর মৃত্যুর পর রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক।
তিনিও সেই সংস্কারের কাজ চালিয়ে যান। তিনি ১৯৯৮ সালে তৎকালীন মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন সংস্কার কাজ তরান্বিত করার জন্য। এর পাশাপাশি তিনি নিজের প্রশাসনিক দায়িত্ব ধীরে ধীরে মন্ত্রীসভার কাছে হস্তান্তর করতে থাকেন। তিনি মন্ত্রীসভাকে ভোটের মাধ্যমে রাজাকে অপসারণ করার ক্ষমতাও দেন। অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপ্রধান থাকলেও সরকারপ্রধান থাকবেন না।
২০০৬ সালে রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক যিনি আগের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক এর পুত্র। জিগমে খেসার রাজা হওয়ার পর ভূটানের সরকার পুরোপুরি গণতান্ত্রিক হওয়ার প্রক্রিয়া আরো বেগ পায়। এরপরের বছরই দেশের অধিবাসীদের একটি নকল ভোটের আয়োজনের মধ্যে দিয়ে নতুন সরকার ব্যবস্থার সাথে পরিচিত করা হয়। ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে ভূটানে প্রথমবারের মত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০০৮ সালের জুলাই মাসের ১৮ তারিখে নতুন সংবিধান ঘোষণা করা হয়।
ভূটানের রাজধানী থিম্পু। এ দেশের জাতীয় ভাষা জংখা যা একটি তিব্বতীয় উপভাষা। বৌদ্ধধর্ম ভুটানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। ভুটানের পাহাড়ি এলাকার বুক চিঁড়ে যেসকল নদী বয়ে চলে সেগুলো হলো: তোরসা (আমো), ওং (রাইদাক), সাংকোস (মো) এবং মানস। নদীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে হিমালয়ে এবং সবগুলো নদী দক্ষিণের দিকে গিয়ে ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিশে।
ভূটানের আবহাওয়া বেশ বৈচিত্র্যময়। যেমন থিম্পু, যা দেশটির পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে জানুয়ারী মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জুলাই মাসে আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ থাকে এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ দেশটির বাকি অঞ্চলগুলো, বিশেষ করে উত্তরের দিকের অঞ্চলগুলো তীব্র ঠান্ডা অথবা গরম অনুভব করে থাকে।
ভূটানে তিনটি প্রধান জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। গোষ্ঠীগুলো হলোঃ ভুটিয়া অথবা গালোপ, নেপালি এবং শারছোপ। সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক ই ভুটিয়া গোষ্ঠীর মানুষ। এরা নবম শতকে ভুটানে আসা তিব্বতী অধিবাসীদের উত্তরাধিকারী। তারা ভুটানের উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী। এরা বেশ কয়েকটি তিব্বতীয়-বার্মা ভাষায় কথা বলে থাকে যার মধ্যে অন্যতম হলো জংখা। এই জংখা ভাষার লিখিত রূপ অনেকটা তিব্বতীয় ভাষার অনুরূপ। এই ভুটিয়ারাই ভুটানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করে থাকে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মিশ্র জাতিসত্ত্বার মানুষ পাওয়া যায়। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী হলো নেপালিরা যারা সাম্প্রতিক সময়েই ভুটানে এসেছে। এরা সবাই নেপালি ভাষায় কথা বলে। নেপালিদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় ভুটান সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৫৯ সালে নেপালিদের আগমন ও বসবাস নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। এই ভুটীয় ও নেপালি গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ্য তেমন একটা নেই, বরং এদের সম্পর্কের বৈরী ভাব ভুটানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ভুটানের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই জাতিগতভাবে ভারতের আসাম ও অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়ি আদিবাসীদের সাথে সম্পর্কিত। এরাই শারছোপ নামে পরিচিত এবং ধারণা করা হয় যে এরাই ভুটানের আদি অধিবাসী।
এই তিন গোষ্ঠির জীবনযাত্রাও অনেক ভিন্ন। একটি সাধারণ ভুটিয়া পরিবারের ঘর কাঠ, মাটি এবং পাথর দিয়ে তৈরি দোতলা স্থাপনা যার নিচ তলায় গৃহপালিত পশু রাখা হয় এবং উপর তলায় পরিবারের সদস্যরা বাস করে। প্রতি ঘরেই একটি ছোট বৌদ্ধমঠ স্থাপন করা হয়। ভুটিয়ারা তাদের গৃহপালিত পশুর মাংস এবং দুধ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। যেসকল পরিবার প্রতিদিন মাংস তাদের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারে না তারা এমা দাতসি (পনির এবং মরিচের মিশ্রণে তৈরী ঝোল জাতীয় খাবার) এবং কেওয়া দাতসি (এমা দাতসির মিশ্রণের সাথে আলু যোগ করা হয়) এই দুইটি খাবার গ্রহণ করে থাকে। এই দুটোকে জাতীয় খাবার হিসেবে গণ্য করা যায় যা সচরাচর বাসমতি চাল অথবা ভুটানের লাল চালের সাথে পরিবেশন করা হয়।
শালছোপদের জীবনযাত্রা অনেকটাই ভুটিয়াদের মত যেহেতু তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা সচরাচর পাহাড়ের ঢালে পাথর এবং কাঠ দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে এবং জুম পদ্ধতির অনুরূপ একটি পদ্ধতিতে চাষের কাজ করে।
নেপালিদের ঘর নির্মিত হয় বাঁশ এবং মাচা দিয়ে। যেহেতু তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী, সেহেতু তারা গোমাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। ভুটানের নেপালিদের মধ্যে জাতপ্রথা বিদ্যমান।
ভুটানের জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম প্রধান চারটি শাখার মধ্যে নিয়িংমা এবং কাগয়িউ এই দুইটি শাখার চর্চা হয় ভুটানে। নিয়িংমা এদের মধ্যে সবথেকে পুরাতন শাখা এবং এটি প্রায় অষ্টম শতক থেকেই ভুটান এবং তিব্বতে চর্চা করা হয়। অপরদিকে কাগয়িউ প্রথার প্রচলন হয় একাদশ শতকের দিকে। এর অসংখ্য উপশাখার মধ্যে দ্রুকপা কাগয়িউ ভুটানে বেশি প্রচলিত। দ্রুকপা কাগয়িউর প্রচলন হয় সতের শতকের দিকে এবং ধীরে ধীরে এই উপশাখাটি ভুটানের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনে বেশি প্রভাব রেখে চলেছে। বর্তমানে ভুটানের বেশিরভাগ মানুষ এই উপশাখার অনুসারী। নিয়িংমা এবং কাগয়িউ প্রথার অনুসারীরা বর্তমানে নিজ নিজ প্রথার সংরক্ষণ করে ধর্ম পালন করে চললেও ঐতিহাসিকভাবেই এদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় আছে।
ভুটানে বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ও আছে। মোট জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশ হিন্দু ধর্মের অনুসারী কেননা ভুটানের জনসংখ্যার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ অংশ নেপালি। ভুটানে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষ ও আছে। ভুটানে ধর্মান্তরিত হওয়া বেআইনি।