প্রিয়জনরা আপনাকে বলে বেশি ‘সেনসিটিভ’ বা অতিরিক্ত সংবেদনশীল। আপনি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও প্রচুর দুশ্চিন্তা করেন।
এই বিষয়গুলো যার সঙ্গে মিলে যায়, তাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় অত্যন্ত ‘সেনসিটিভ’ বা সংবেদনশীল বা অভিমানী মানুষ।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ইলেইন অ্যারন বলেন, “পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশের মাঝে এমন মানসিকতা দেখা যায়। এই মানুষগুলোর মাঝে চোখে পড়ে ‘সেন্সরি প্রসেসিং সেনসিটিভিটি (এসপিএস)’ যার ফলশ্রুতিতে তাদের স্নায়বিক সাড়ার মাত্রা থাকে বেশি। অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক যে কোনো ব্যাপারেই তাদের প্রতিক্রিয়া হয় অন্যদের তুলনায় তীব্র।”
আরেক মনোবিজ্ঞানী শ্যারন মার্টিন হেল্থটুডে ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “অতিরিক্ত সংবেদনশীল মানুষগুলো যেকোনো বিষয় নিয়েই সাড়া দেয় তীব্রভাবে।”
পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় যেমন উজ্জ্বল আলো, তীব্র শব্দ ইত্যাদি তাদেরকে নাড়া দেয় কঠোর ভাবে। আবেগতাড়িত যে কোনো আলোচনায় এই মানুষগুলো দ্রুত ভেঙে পড়েন। এটা কোনো রোগ নয় যে তা নির্ণয় করা হবে, যার যার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য। এরা যাকে ভালোবাসেন, তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। তবে সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করে ফেলতেও তাদের জুড়ি নেই।
এই প্রেক্ষিতে ‘বাউন্ডারি’ বা সীমাবদ্ধতা শব্দটা নেতিবাচক মনে হতে পারে। আসলে ব্যাপারটা তার বিপরীত।
মানুষের জন্য সীমাবদ্ধতা তৈরি করার পেছনে কারণটা হবে নিজেকে ভালো রাখা।
মার্টিন বলেন, “অতিরিক্ত সংবেদনশীল বা অভিমানী মানুষ যেহেতু বাহ্যিক বিভিন্ন ঘটনায় তীব্রভাবে প্রভাবিত হন, তাই যা তারা সহ্য করতে পারবেন না তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার মাধ্যম হবে ওই সীমাবদ্ধতা। এতে মানুষের প্রতি আকাঙ্ক্ষা হবে সীমিত, যা পক্ষান্তরে মন ভাঙা থেকে সুরক্ষা দেবে।”
নিজের চাওয়া আর অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়া
অন্যের মন রক্ষা করতে সবসময় ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো নিজের চাওয়াগুলোর খেই হারাবে এটাই স্বাভাবিক। আবার এত মানুষের মন রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটার মন রক্ষা যদি না হয় তবে তারা আরও মুষড়ে পড়েন।
প্রিয় মানুষগুলোরই উচিত হবে এই অতিসংবেদনশীল মানুষটাকে মানসিক অশান্তি থেকে বাঁচাতে কিছু আবেগ তার সামনে প্রকাশ না করা।
মার্টিন বলেন, “আপনার চিন্তা, অনুভূতি, শারীরিক ইন্দ্রিয়ানুভূতি আপনাকে বলে দেবে কোথায় আপনাকে সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে হবে। যেমন- যখন আপনি ক্লান্ত তখন আপনাকে ভাবতে হবে সীমাবদ্ধতার কথা। যাতে ক্লান্তি দূর করতে পারেন, হারানো কর্মশক্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন। বিরক্ত বা রাগ অনুভব করলে সীমাবদ্ধতার কথা ভাবতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সম্ভবত আপনার সীমাবদ্ধতা তৈরি না করা কিংবা নিজের অস্বস্তির কথা মুখ ফুটে না বলার কারণেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই জানতে হবে আপনি কী চান, কতটুকু চান, কীভাবে চান এবং সেই চাহিদাগুলো প্রাধান্য দিতে হবে।”
নিজের প্রয়োজন চাইতে শিখতে হবে
নিজের চাহিদাগুলো নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরের ধাপ হলো তা আদায় করা। অতিরিক্ত সংবেদনশীল মানুষগুলো তাদের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদাগুলো প্রকাশ করতে পারেন না প্রায়শই। ভয় থাকে যদি ফিরিয়ে দেয়। এতে দুজনার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়।
মার্টিন বলেন, “অনেক সময় অন্যের মন রক্ষা করার ইচ্ছেটার পেছনে উদ্দেশ্য হয় মানুষের প্রিয়পাত্র হওয়া। আর সেই আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয় তখনই যখন মানুষের কাছে শুনতে হয় ‘তুমি অতিরিক্ত সংবেদনশীল’। এই সংবেদনশীল মানুষগুলো চায়, আমি যেমন মানুষ আমাকে সেভাবেই গ্রহণ করুক। কিন্তু নিজের চাওয়াগুলো সরাসরি বলতে না পারার কারণে সেখানে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। তাই মনের কথা সরাসরি বলতে শিখতে হবে, অভ্যাস করতে হবে, সেই অভ্যাসের নিয়মিত চর্চা করতে হবে।
ছোট করে শুরু করা
সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে হবে বলে একবারে সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে বোকামি।
তাই মার্টিন পরামর্শ দিচ্ছেন ছোট ছোট ধাপে শুরু করার। কিছু বিষয় আপনি নিজেই সামলে নিতে পারেন। যেমন আড্ডা থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর আপনি উঠবেন। তাতে আর কেউ চলে যাক বা না যাক, আপনি যাবেনই।
কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও অফিসের কাজ একটা নির্দিষ্ট সময় পর আর করবেন না এমন পন করে নিতে হবে। এমন গণ্ডি যত তৈরি করতে পারবেন ততই আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
অন্যদের না বলা ক্ষেত্রে শুরুটা হওয়া উচিত ভদ্রভাবে না বলার মধ্য দিয়ে। কারও সাহায্যের প্রত্যাশার বিপরীতে বলতে পারেন, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু এখন আমি অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত। অন্য সময়ে চেষ্টা করবো।’
এই ভদ্রভাবে ‘না’ করা দিয়ে আপনি নিজেকে প্রাধান্য দিলেন। তবে মানুষকে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুত দেওয়ার আগে ভেবে নিতে হবে আপনি আসলেই ভবিষ্যতে সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে চান কিংবা তা পূরণ করতে পারবেন কি-না।
নিজের মূল্যায়ন করুন
অতিরিক্ত সংবেদনশীল বা অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলো একাকিত্ব ভয় পায়, আবার একা সময় কাটাতেও চায়। তারা সেই মানুষগুলোর সঙ্গেই থাকতে চায় যারা তার মূল্য দেয়।
তবে অন্যের কাছ নিজের মূল্যায়ন পাওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে আপনি নিজেকে সত্যিকার অর্থে মেনে নিয়েছেন এবং সবাইকে নিজের ব্যক্তিত্বের আসল রূপটা দেখাতে দ্বিধা করেন না।
আপনি হয়ত বেশি একা থাকতে পছন্দ করেন, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আপনার একটু বেশি সময় লাগে, সেটা দোষের কিছু নয়। আপনি যেমন নিজেকে তেমনভাবেই উপস্থাপন করুন।
অন্যের মূল্যায়ন পাওয়া জন্য নিজেকে বদলানো চেষ্টা করা উচিত নয়। এমনটা করলে আপনি নিজেই নিজেকে মূল্যায়ন করলেন না।