করোনার মহামারীতে অনেকটাই ঘরবন্দি মানুষ। প্রযুক্তির উন্নয়নে হাতে হাতে মোবাইল। সহজলভ্য ইন্টারনেট যেন বিনোদনের পসরা সাজিয়েছে মানুষের জন্য। ২৩ বছর আগে ১৯৯৭ সালে নেটফ্লিক্স দিয়ে শুরু। এরপর অ্যামাজন, ডিজনির মতো বড় কোম্পানিগুলোও এসেছে মিলিয়ন ডলারের মুঠোফোনভিত্তিক ওভার দ্য টপ বা ওটিটি দুনিয়ার বিনোদন বিপণনে। প্রতিবেশী ভারতের জি ফাইভ, ম্যাক্স প্লেয়ার, হইচইসহ বেশ কয়েকটি ওটিটি প্লাটফর্ম জনপ্রিয় দর্শকদের কাছে। সময়ের দাবি মেনে বাংলাদেশেও সিনেমা হল, টিভি, ডিভিডিকে সরিয়ে ধীরে ধীরে বিনোদনের ক্ষেত্র দখল করে নিচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্ম বায়োস্কোপ, বঙ্গ, আইফ্লিক্স, রবি টিভি প্লাস, সিনেস্পট, হইচই, জি ফাইভ, অ্যামাজন ও নেটফ্লিক্স। দেশী ওটিটি আঙিনায় সবশেষ চলতি বছর জুনে যুক্ত হয়েছে চরকি।
এসব প্লাটফর্মের বড় সুবিধা সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় তাদের ব্যবসা সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশেও বিপুলসংখ্যক মানুষ টাকা খরচ করে এসব প্লাটফর্ম থেকে সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজ কিংবা প্রামাণ্যচিত্র দেখে। তবে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে ওয়েব সিরিজ। যাতে স্বল্পদৈর্ঘ্যের কয়েক পর্ব মিলে একটি গল্প/কাহিনী উপভোগ করেন দর্শক।
জনসংখ্যার হিসাবে বাংলা বিশ্বের পঞ্চম ভাষা হলেও ওটিটির আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলা ভাষার কন্টেন্ট খুব কম। সে তুলনায় বাংলাদেশী ওয়েব সিরিজ তো হাতেগোনা। স্বস্তির বিষয় হলো ভিনদেশী ওটিটি প্লাটফর্মে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী ওয়েব সিরিজ দর্শক-সমাদৃত হচ্ছে। এ তালিকায় সবশেষ যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশী লেখক মোহাম্মদ নাজিদ উদ্দীনের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ উপন্যাস অবলম্বনে বানানো ওয়েব সিরিজটি। ১২ আগস্ট এটি ওটিটি প্লাটফর্ম হইচইয়ে মুক্তি পায়। ভারতের খ্যাতিমান পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এতে গুরুত্বপূর্ণ মুশকান জুবেরি চরিত্রে অভিনয় করেন রেহানা মরিয়ম নূর খ্যাত অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন। যদিও সব চরিত্রেই বাংলাদেশী থাকার কথা ছিল। তাই ওয়েব সিরিজটি নিয়ে দুদেশের বাংলাভাষী দর্শকদের মাঝে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়।
এর আগে ওপার বাংলা-এপার বাংলায় তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ মহানগর। আশফাক নিপুণের বানানো আট পর্বের এ সিরিজে একটি থানার ঘটনাবহুল এক রাত দেখানো হয়েছে। এটি দেখে মুগ্ধতা জানান কলকাতার খ্যাতিমান নায়ক প্রসেনজিৎ। প্রশংসা করেন ভারত বাংলাদেশের গুণী নির্মাতা ও অভিনেতারা। অনেকে মহানগরকে ভারত-বাংলাদেশ মিলে এ যাবত্কালের সেরা বাংলা ওয়েব সিরিজের স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্লাটফর্ম ভারতীয় হলেও নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, দৃশ্যায়ন সবই বাংলাদেশের। দর্শক এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দ্বিতীয় সিজনের জন্য।
৯ জুলাই রাতে ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম জি ফাইভে মুক্তি পায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান। মধ্যবিত্ত সংসারে চাকরিজীবী নারীর সংকট এতে ফুটিয়ে তোলেন তাসনিয়া ফারিণ। এছাড়া খ্যাতিমান অভিনেতা আফজাল হোসেন এ ওয়েব সিরিজটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। ওয়েব সিরিজটির ব্যাপক প্রশংসা করেন কলকাতার কবি ও লেখক বিভার রায়চৌধুরী। আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি লিখেন, চার ঘণ্টার বেশি দৈর্ঘ্যের আট পর্বের একটি সমাজসচেতন ওয়েব সিরিজ তৈরি করা এবং দীর্ঘ সময় দর্শককে টেনে রাখা সহজ কথা নয়। ফারুকী চমত্কারভাবে দেখিয়েছেন কর্মরত নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অফিসে যেসব অভিযোগ কেন্দ্র বা কমিশন আছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেগুলো কার্যকারিতাহীন। বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ে দেশের কর্মজীবী নারীদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল, তার গল্পই এ সিরিজে তুলে আনা হয়েছে। তিনি মহানগরকে ওয়েব সিরিজের সম্পদ বলেও মন্তব্য করেন।
মহানগরের আগে চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত রহস্য ও থ্রিলারধর্মী ওয়েব সিরিজ তাকদীরও ব্যাপক দর্শকনন্দিত হয়। এটি মুক্তি পায় হইচইয়ে। দেশের সীমানা পেরিয়ে ওপারের দর্শকদেরও দারুণ মুগ্ধ করে তার অভিনয়। এতটাই যে ভারতের খ্যাতিমান গায়ক ও পরিচালক অঞ্জন দত্ত তার সঙ্গে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন চঞ্চল চৌধুরীকে। এজন্য পরপর তিনদিন ফোন করেন তিনি।
এছাড়া ওটিটি প্লাটফর্ম জি ফাইভ, হইচই অরিজিনালে বেশকিছু বাংলাদেশী নাটক রয়েছে। এগুলো হলো মানহানি (হইচই), একাত্তর (হইচই), ঢাকা মেট্রো (হইচই), কন্ট্র্যাক্ট (জি ফাইভ), যদি কিন্তু তবুও (জি ফাইভ)।
শুধু ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্মে নয়, ওয়েব সিরিজের দর্শক বাড়ছে বাংলাদেশী প্লাটফর্মেও। পরপর বেশ কয়েকটি ওটিটি প্লাটফর্ম যাত্রা শুরু করেছে গত দুই বছরে। গত ৩ জুন এসেছে চরকি। এতে ওয়েব সিরিজ মরীচিকা, ঊনলৌকিক, ইউটিউমার প্রশংসা কুড়ায় দর্শকদের।
দেশী আরেকটি ওটিটি প্লাটফর্ম বিঞ্জের সবচেয়ে আলোচিত ওয়েব সিরিজ ১৪ আগস্ট। পুলিশ কর্মকর্তা বাবাকে খুন করা ঐশীর ঘটনা অবলম্বনে এটি নির্মাণ করেন শিহাব শাহীন।
ওয়েব সিরিজসহ ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে দেশী কন্টেন্ট নিয়ে আশাবাদী মহানগরের নির্মাতা আশফাক নিপুণ। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ওটিটি প্লাটফর্ম বড় সম্ভাবনা। কারণ ওটিটির কারণে সব শিল্পীর কাজের পরিধি বাড়ছে। লোকাল কন্টেন্ট উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বে।