নৃগোষ্ঠীগুলোর লোকবিশ্বাস অনুযায়ী চৈত্র মাসের শুরুতেই একটি পাখি এসে ‘বিজু’ বলে ডাক দিয়ে যায়। চাকমা সম্প্রদায় এ পাখিকে ‘বিজু পেইক’ বা ‘বিজু পাখি’ বলে। এই পাখির সুমধুর কলতান বিজু বা চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। কখন বিজু আসবে, উৎসব করবে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে পাহাড়িরা। পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে নৃগোষ্ঠীগুলো তিনদিনব্যাপী এই বর্ষবরণ উৎসব সেই প্রাচীনকাল থেকে পালন আসছে মহাধুমধামে। এ উৎসবে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। কেউ কারও প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে না, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে না। এ কারণে বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘বৈসাবি অহিংসার প্রতীক, বন্ধুত্বের প্রতীক এবং মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন।’
এই বর্ষবরণ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসু’ বলে অভিহিত করলেও পুরো পার্বত্য জেলায় তা ‘বৈসাবি’ নামেই পরিচিত। বছরের শেষ দুদিন এবং নুতন বছরের প্রথমদিন মোট তিনদিনই মূলত বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।
‘বৈসাবি’র প্রথম অক্ষর ‘বৈ’ বাংলার বৈশাখের সঙ্গেও মিলে যায়। তবে বৈসাবি শব্দটি এসেছে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা ভাষায় সংক্রান্তি ও নববর্ষের উৎসবের নামের তিন আদ্যক্ষর নিয়ে (বৈ+সা+বি=বৈসাবি)। ‘বৈ’ মানে ‘বৈসু’ এটি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ভাষা, ‘সা’ মানে ‘সাংগ্রাই’ এটি মারমা সম্প্রদায়ের ভাষা এবং ‘বি’ মানে বিজুÑ এটি চাকমা সম্প্রদায়ের ভাষা। বছরের প্রথম দিনকে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈজু’, মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা সম্প্রদায় ‘বিজু’ নামে অভিহিত করে থাকে। বৈসাবি উৎসব পালনের রীতিগুলো এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
বৈসু : পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানকে ‘বৈসু’ উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরারা এদিনে অনাগত দিন যাতে সুখের হয়, দেশ সমৃদ্ধি লাভ করে, এ কামনায় মন্দিরে গিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে বিশেষ প্রার্থনায় রত থাকেন। শিশু-কিশোরের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে এবং তরুণ-তরুণীরা তাদের প্রিয়জনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। এখানে উল্লেখ্য, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘বৈসু’কে তিন পর্বে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। এগুলো হলো ‘হারি’, ‘বিজু’ ও ‘বিসিকাতাল’। এই উৎসব পালনকালীন তারা জাতিভেদ হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছু পরিত্যাগ করে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক সুখের বাতাবরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিজু দিনে তারা পাচন, সেমাই, পিঠা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে। গরু-মহিষের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তারা ফসলসহ নানা দ্রব্যাদি উৎপাদন করে বিধায় গরু-মহিষকে স্নান করিয়ে এদের গলায় পাহাড়ি কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এভাবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজু উৎসব বছরের শেষ দিনে মহাসমারোহে উদযাপন করে।
সাংগ্রাই : সাংগ্রাই শব্দটি মার্মা ভাষার। মার্মা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনে নানা অনুষ্ঠান পালন করে। যার কারণে এ দিনটিকে ‘সাংগ্রাই’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সেমাই, পাঁচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা সম্প্রদায়। একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশল বিনিময় করে এবং আনন্দ উৎসবে মেতে থাকে। উল্লেখ্য, মারমা সম্প্রদায়ের এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ‘জলোৎসব’। জলকেলি দৃশ্য বেশ উপভোগ্য বলে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে উৎসবস্থলে। মারমা ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘রিলংপোয়ে’। জলখেলার জন্য এরা আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে। ঐ প্যান্ডেলে যুবক-যুবতীরা একে অপরের প্রতি জল ছিটিয়ে মেরে কাবু করার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়। বয়স্করা এদিনে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক ধর্ম অনুশীলনে রত থাকেন। শিশু-কিশোররা জল ছিটিয়ে আনন্দ-উল্লাস পালন করার পাশাপাশি দড়ি টানাটানি, হা-ডু-ডু ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে সাংগ্রাই উৎসবকে বিদায় জানায়।
বিজু : বিজু হলো চাকমা ভাষা। চাকমা সম্প্রদায় বিজু উৎসবকে তিনভাগে ভাগ করে পালন করে থাকে। বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুল বিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূল বিজু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে ‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ নামে রকমারি উৎসব পালন করে।
‘ফুল বিজু’র দিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নানা রকমের ফুলের সন্ধানে শিশু-কিশোরের দল সবুজ পাহাড়ি গহিন অরণ্যে বিচরণ শুরু করে দেয়। ফুল সংগ্রহ শেষে এরা বাড়িতে ফিরে এসে ফুলগুলোকে চারভাগে ভাগ করে একভাগ দিয়ে নিজের মনের মতো করে ঘরবাড়ি সাজায়। দ্বিতীয় ভাগ ফুল নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে যায়। বুদ্ধের উদ্দেশ্যে ফুল উৎসর্গ করে সমবেত প্রার্থনায় রত হয়। পঞ্চশীলে সকলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক দেয় ধর্মীয় নির্দেশনা শ্রবণ করে। তৃতীয় ভাগ ফুল ছড়া, নদী বা পুকুরের পাড়ে পূজা ম-প তৈরি করে সেখানে প্রার্থনা করে যেন সারা বছর পানির মতো অর্থাৎ পানি যেমন শান্তশিষ্ট, ধীরে প্রবহমান সে ধরনের জীবনযাপন সকলে যেন করতে পারে। চতুর্থ ভাগ ফুল তারা প্রিয়জনকে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
‘মূল বিজু’ হচ্ছে বিজুর প্রথম দিন। ফুল বিজুর দিনে মূল বিজুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। এদিনে ঘরের মহিলারা খুবই ব্যস্ত থাকে। ত্রিশ-চল্লিশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও অধিক কাঁচা তরকারির সংমিশ্রণে পাঁচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। পাঁচন ছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, পায়েস, মাছ-মাংসের আয়োজনও থাকে। বছরের ঐতিহ্য হিসেবে থাকে বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাইয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি মদও পরিবেশন করা হয় আগত মেহমানদের। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ সকলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং নানা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘরের দরজায়, উঠানে, গো-শালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সকলের মঙ্গল কামনা করা হয়।
‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ পালিত হয় নববর্ষের প্রথম দিনে। চাকমারা এদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রাম করে দিন অতিবাহিত করে। ছোটরা বড়দের নমস্কার করে এবং স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সকলে স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে মশগুল থাকে। ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক ধর্মদেশনা শুনে অনাগত দিন সুখেশান্তিতে কাটানোর জন্য বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে। এভাবে গজ্যাপজ্যা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে।