আশি-নব্বই দশকে বাংলা চলচ্চিত্র জগত একপাক্ষিক ছিলো না। কাহিনী নির্ভর ছবি তৈরি হতো। নায়ক নায়িকার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও খলনায়ক আর সঙ্গে জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতার ভূমিকা ছিলো তুলনাহীন। বিভিন্ন ভূমিকার কারণে চলচ্চিত্রগুলো থাকতো মানুষের মণিকোঠায়।
একজন কৌতুক অভিনেতা শুধু মানুষকে হাসায় না, কাঁদায়ও। তার অভিব্যক্তি দর্শকদের মনকে নাড়িয়ে তোলে। সেই রকম একটি চরিত্র মানুষের মনে গেঁথে আছে। নাম তার দিলদার। দিলদারকে অনেক ছবির নায়ক-নায়িকার চেয়েও শক্তিশালী ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছি।
শুধু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নয়, বিশ্বের সব দেশের চলচ্চিত্রে একটা বড় অংশ জুড়েই থাকে কৌতুক পর্ব। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, ঢাকার চলচ্চিত্র বর্তমানে আগের জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কৌতুকের মতো বড় চরিত্রগুলো। আমাদের নিত্যদিনের জটিলতায় জীবন যখন নাভিশ্বাসে উঠে যায়, ঠিক তখন একটু হাসি এনে দিতে পারতেন দিলদারের মতো অভিনেতারা। একজন কৌতুক অভিনেতা নায়ক বা খলনায়কের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। বাংলা চলচ্চিত্রের শুরুতে যারা দর্শকদের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই।
বাংলা চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকজন কৌতুক অভিনেতা আছে যাদের নাম না বললে আমার লেখাটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কতগুলো নাম আর তাদের অভিনয় চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, দিলদার ছাড়া অন্যরা হলেন সাইফুদ্দিন, হাসমত, পরান বাবু, মতি, ব্ল্যাক আনোয়ার, রবিউল, আনিস, টেলি সামাদ, কাজল, সুরুজ বাঙালী, আফজাল শরীফ প্রমুখ।
জীবদ্দশায় কৌতুক অভিনেতা দিলদার অঘোষিতভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের কমেডির রাজপুত্র বনে গিয়েছিলেন। একজন কৌতুক অভিনেতা দিলদারের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে এমন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, তাকে নায়ক করে ‘আব্দুল্লাহ’ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। সেই চলচ্চিত্রে একজন কমেডিয়ানের খোলস ছেড়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন অন্যরূপে। দর্শক তার অভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি দিলদারও দেখিয়েছিলেন চরিত্রের বৈচিত্র্যতা।
পৃথিবীর সব চেয়ে কঠিন কাজ মানুষকে হাসানো। জীবন চলার পথে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত। কারো চিন্তা জটিল কিংবা কারো চিন্তা ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এমন একটি মুহূর্তে মন বিষন্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। এই বিষন্ন মনকে কিছুটা ভালো রাখতে আমরা আশ্রয় নেই বিনোদনের দিকে। সেই সব বিনোদনগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্র একটি উত্তম মাধ্যম। কেননা মনের মতন একটি চলচ্চিত্রই পারে আপনার মনে প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে।
প্রায় নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতাদের চাহিদা ছিলো অপরিসীম। তখন অবস্থা এমন ছিল যে, কৌতুক পর্ব ছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণ করা অসম্ভব ছিল। আর এখন এই প্রধান বিনোদনটিই চলচ্চিত্র থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। নেই আগের মতো কৌতুক অভিনেতা এবং কৌতুক দৃশ্য। যে জন্য বর্তমানে সিনেমা দেখে আনন্দ না পাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে যুক্ত হয়েছে চলচ্চিত্রে কৌতুক পর্ব বা কৌতুক অভিনেতা না থাকা।
বাংলার চলচ্চিত্রে কমেডিয়ান আর দিলদার যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে উঠেছিলো। ২০০৩ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ প্রায় ১৮ বছর হতে চলল দিলদারের শূন্যতা এখনো পূরণ হয়নি। বাংলা চলচ্চিত্রকে মানুষের মনে স্থান দিতে একজন দিলদারের খুবই প্রয়োজন।