শেষবার ভারতীয় দল সবচেয়ে বেশি বল খেলে চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ ড্র করেছে। এমন পরিসংখ্যান খুঁজে পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯০ সালে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতীয় দল চতুর্থ ইনিংসে করতে উরকি রামান এবং মনোজ প্রভাকর উদ্বোধনী জুটিতে ২৭০ বল খেলে করেছিলেন মোট ১৪৯ রান। এরপর ওই বছরই ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে ৪০৮ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ ইনিংসে শচিন টেন্ডুলকারের সঙ্গে ৭ম উইকেটে মনোজ প্রভাকর ২৪৮ বলে ১৬০ রানের জুটি গড়েন। এই দুই ঘটনার পর কেটে গেছে দীর্ঘ ৩০ বছর। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আবারও ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং হনুমা বিহারি।
ক্রিকেট বিশ্লেষকরা অহরহই বলে থাকেন টেস্ট ক্রিকেটেই ক্রিকেটের আসল আনন্দ। ক্রিকেটের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায় টেস্ট ক্রিকেটেই। ১১ জানুয়ারি ২০২১ সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি অনবদ্য ক্রিকেট ম্যাচেরই উপহার দিলেন ভারতের লোয়ার অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে একজন তো স্বীকৃত ব্যাটসম্যানই নন।
দলীয় ২৭২ রানে চেতেশ্বর পুজারা (৭৭) যখন আউট হয়ে ফিরছিলেন তখনও দিনের খেলার ৪৩ ওভার মতো বাকি। আর ভারত এর মধ্যেই হারিয়ে ফেলে পাঁচ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে। তখন আর কে বা ভেবেছিল দিনের বাকি সময়টা বীরত্ব গাঁথা লিখবে হনুমা বিহারি আর অশ্বিন।
জশ হ্যাজেলউডের বলে পুজারা যখন বোল্ড হয়ে ফিরলেন সেই সময় উইকেটে আসলেন অশ্বিন। এসে দেখলেন হনুমা বিহারির পক্ষে দৌড়ে রান নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে গত দিন নিজেও ইনজুরিতে পড়েছিলেন অশ্বিন। আগের রাতে সারারাত বিছানায় পিঠ ঠিকভাবে দিতে পারেননি। স্ত্রী প্রীতি বলেছেন যে আশ্বিন নাকি জুতার ফিতা বাঁধার জন্য পিঠটা বাঁকা করতেও পারছিলেন না। ড্রেসিংরুমে বসতে পারছিলেন না। তবে মাঠে যখন নামছিলেন দেখে বোঝায় কোনো রাস্তাই ছিল না অশ্বিন আদৌ এমন ইনজুরিতে পড়েছেন। কারণ? দেশের জন্য নিজেকেই সবার আগে উজাড় করে দেওয়ার পণ করে রেখেছেন এই ভারতীয়। অশ্বিন-বিহারির এমন দৃঢ় ব্যাটিং দেখে উইকেটের পেছনে থাকা টিম পেইন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। এই দুইয়ের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে আশ্রয় নিলেন তাদের মহাস্ত্রের। টিম পেইন স্লেজ করেই যাচ্ছেন, এর ভেতর অশ্বিন পেছনে ফিরে ইংরেজিতেই জবাব দিচ্ছেন। আর হনুমা বিহারি মুখ ঘুরিয়ে তামিল ভাষায় কিছু একটা বলছেন। তবে না, তাতে দুইজনের এক ফোটা মনোযোগে ফাটল ধরাতে পারেনি অজিরা, আর নিজেরাও নিজেদের মনোযোগকে ভেঙ্গে পড়তে দেননি এই দুই ক্রিকেটার।
হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাওয়া বিহারি শক্তিশালী পেইন কিলার খেয়েছেন। একেকবার পানির বোতল নিয়ে অতিরিক্ত খেলোয়াড়েরা এসে বিহারিকে একেকটা পেইন কিলার খাইয়ে গেছেন। একটা সময় দেখা গেলো তাঁর রান ১০০ বলে ৬, ১২৪ বলে ৭!
ব্যাথায় কাতর বিহারি উইকেটের এক প্রান্ত থেকে এক রান নিতে বারণ করছেন, অন্যদিকে আশ্বিন মানা দাঁড়িয়ে থাকেন ঠাই হয়ে। কামিন্স, স্টার্ক, হ্যাজেলউড কিংবা নাথান লায়নরা বল হাতে আসছেন আর একের পর এক মেইডেন দিয়ে চলে যাচ্ছেন। একের পর এক ওভার মেডেন যাচ্ছে। কামিন্স, স্টার্করা তাঁদের সব নিংড়ে দিচ্ছেন শরীর বরাবর। সংখ্যার হিসেব করলে দেখা যায় ভারতীয় ইনিংসের ১৩১টি ওভারের ভেতর ৪৩টি ওভার মেইডেন গেছে।
তবে তাতে কি? বিহারি-অশ্বিন যেন রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ন্যূনতম ৪০টা সিঙ্গেলস তাঁরা নেননি, ডাবলসের সংখ্যাটাও হবে তেমনই। এই রানগুলো যদি নেওয়ার ঝুঁকি তারা নিতে তবে হয়তো ক্রিকেট বিশ্ব দেখতে পেতো না এমন উপভোগ্য একটি ম্যাচ। হয়তো হতো না সৃষ্টি ইতিহাসের! ও হ্যাঁ! আজই আবার ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার রাউল দ্রাবিড়ের জন্মদিন। তবে কি অশ্বিন-বিহারি তাকেই উৎসর্গ করলেন এই বীরত্ব?