৫০ বছরে বাংলাদেশ! স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রায় এক মহাসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। অনেক ত্যাগ, অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছে এ স্বাধীনতা। সেজন্য এদেশের বীর যোদ্ধা যারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সেসব বীর সূর্য সৈনিকদের জানাই অজস্র সালাম আর শ্রদ্ধা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’- এর মাহেন্দ্রক্ষণে উদযাপিত হচ্ছে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। এটি সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক আনন্দঘন গৌরবের অনুভূতি। বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় একের পর এক মাইলফলক অর্জন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকে মহিমান্বিত করেছে।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসে বাংলাদেশ অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। সাফল্য এবং ব্যর্থতার মানদণ্ডে সাফল্যের মেরু তুলনামূলক বেশি ভারী। সর্ব সেক্টরে অর্জন করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলছে প্রিয় মাতৃভূমি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমাদের প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ দেওয়া আমাদের জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল। কাজটা আমাদের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে সম্ভব হয়েছে। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রকে মাটিচাপা দিয়ে তিন বছর দুই মাস ১০ দিনের মাথায় নিজস্ব অর্থায়নে পূর্ণতা পেয়েছে বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতু ভবিষ্যতে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও শিল্প উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পাশাপাশি মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উেক্ষপণ, কর্ণফুলী টানেলসহ দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিল।
সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারের রূপকল্প- ২০২১-এর মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে বাংলাদেশকে ‘দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই যেসব দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল শ্রীলঙ্কা তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আরো বলেছেন, বাণিজ্য আর বিনিয়োগে শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশ। অন্যদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে গণ্য করে রাশিয়া।
অথচ এই বাংলাদেশকে এক দিন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এদেশকে বিশ্ববাসী চিনতো বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে। আজ আমাদের সে পরিচয় ঘুচে গেছে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লিগ টেবিল ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। যেখানে ১৯৬টি দেশের মধ্যে এর অবস্থান হবে ২৫তম। সময়ের পরিক্রমায় দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হওয়ায় আমাদের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ মার্কিন ডলারে যা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছিল অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১২৯ ডলার।
স্বাধীনতাযুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণের আত্মদানে পরাধীনতার লৌহকঠিন শৃংখল ভেঙে যারা লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছে এই বাংলার পলল ভূমিতে সেই দেশ প্রেমিকদের চেতনায় আগামীর পথে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতার সুফল বয়ে আনতে হবে।
ধংসস্তূপ থেকে টেনে তুলে নতুন করে বাংলাকে সুখী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার শপথ ও স্বপ্নবীজ ছড়িয়ে দেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার মাস মার্চ এলেই মনের দরজায় প্রশ্নটি কড়া নাড়ে যে, তরুণদের মন ও মগজে কতটা প্রোথিত হয়েছে স্বাধীনতার মর্মবাণী? ৭, ১৭ বা ২৬ নানা কারণেই মার্চ আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের কারণে এবারের মার্চটি বিশেষভাবে অর্থবহ ও অনবদ্য। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের আর মাত্র একবছর। এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তরুণরা কী ভাবছে-স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে? তারা কতটুকু প্রাণিত হচ্ছে দেশপ্রেম ও দেশ গড়ার কাজে? কীভাবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে জাতির পিতার জীবনাদর্শ, উন্নয়ন দর্শন, প্রেরণাময়ী ভাষণ ও ভাবনায়?
তরুণ প্রজন্ম যদি আদর্শ তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ওঠে এবং নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দেশ-প্রেমের জাগ্রতচিত্ত তুলে ধরতে সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে আগামীর পথে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুফল পেতে পারে। এই তরুণ প্রজন্মের তারুণ্যের শক্তি বলিয়ান করতে হলে সর্বপ্রথম মানবতাবাদ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে আমাকে, আপনাকে, সমাজকে। সকলের সংমিশ্রণে গড়ে তুলতে হবে তারুণ্যে সৃজনীশক্তি। সেই শক্তিই হবে জাগ্রত তারুণ্যের আগামীর পথে বাংলাদেশ।
আর আজ আমরা মাথা উঁচু করে গর্বভরে এমন এক বাংলাদেশের কথা বলছি, যে বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছে। এ দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। বিবেচনা করছে ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে। একসময় দক্ষিণ কোরিয়াকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এখন সে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের পূর্বাভাসে বলেছে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলার পথে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু একই বৃত্তে তিনটি চেতনার ফুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী-মেহনতী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া, শত যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট-বেদনাকে সহ্য করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু চিরদিন অম্লান এবং বাংলার জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আজও আমাদের প্রেরণা জোগায় নির্ভীক যোদ্ধা হওয়ার, দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদিত রাখার। এর মধ্য দিয়েই বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আসবে প্রকৃত মুক্তি। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা।