কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবহার করেন কিন্তু 'ম্যাকাফি'র নাম জানেন না এমন খুঁজে পাওয়া দুস্কর। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে ম্যাকাফি হচ্ছে জনপ্রিয় অ্যান্টিভাইরাস ও ইন্টারনেট সিকিউরিটি প্রটোকল। ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কাছে 'ভাইরাস' সত্যিকারে একটি আতঙ্কের নাম। এই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে সবচেয়ে কার্যকর ও জনপ্রিয় হলো অ্যান্টি ভাইরাসের ব্যবহার। কিন্তু কে প্রথম এই অ্যান্টিভাইরাস আবিস্কার করেছিলেন? জানেন কি? জন ডেভিড ম্যাকাফি। তিনি বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারের উদ্ভাবক। তার নামেই তার উদ্ভাবিত অ্যান্টিভাইরাস ম্যাকাফি বাজারজাত হয়ে আসছে। তিনি অ্যান্টিভাইরাসের গুরু হিসেবে খ্যাত ছিলেন। গত ২৩ জুন স্পেনের বার্সেলোনার একটি কারাগারের কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে। কারাগার থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সব ইঙ্গিত দেখে মনে হচ্ছে, ম্যাকাফি নিজেকে নিজেই শেষ করে (আত্মহত্যা) দিয়েছেন!
১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকে প্রযুক্তি খাতের বিকাশে ম্যাকাফি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ম্যাকাফি ভাইরাস স্ক্যানার উদ্ভাবনের কারণে কম্পিউটার বিশ্বে শত শত কোটি ডলারের শিল্প গড়ে ওঠে। পরে প্রযুক্তিজগতে প্রভাবশালী ইন্টেলের কাছে এটি ৭৬০ কোটি ডলারে বিক্রি করা হয়। ইংল্যান্ডের গল্গস্টারশায়ারে ১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা খ্যাতির আলোয় আসেন গত শতকের আশির দশকে যখন তিনি ম্যাকাফি ভাইরাসস্ক্যান তৈরি ও প্রকাশ করেন। ম্যাকাফির শৈশব কাটে ভার্জিনিয়ার সালেমে। তিনি ১৯৬৭ সালে রোয়ানোক কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাঁদে প্রথমবার মানুষ পাঠানোর 'অ্যাপোলো' প্রোগ্রামে কাজ করেছেন তিনি। সেখান থেকে ইউনিভ্যাকে সফটওয়্যার ডিজাইনার এবং তারও পরে জেরক্সে অপারেটিং সিস্টেম আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৮ সালে কম্পিউটার সায়েন্স করপোরেশনের সফটওয়্যার পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০-এর দশকে লকহিডে কর্মরত অবস্থায় ম্যাকাফি পাকিস্তানি ব্রেইন নামীয় কম্পিউটার ভাইরাসের কপি সংগ্রহ করেন এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে মোকাবিলার লক্ষ্যে সফটওয়্যারের কাজ শুরু করেন। ব্যায়াম বিষয়ে ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। নিজেকে ৪৭ সন্তানের জনক দাবি করা ম্যাকাফি তার 'বেপরোয়া' জীবনের জন্যও সমালোচিতও ছিলেন।
অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করলেও তিনি নিজের কম্পিউটারে নিজের বা অন্য কারও তৈরি কোনো অ্যান্টিভাইরাস কখনও ব্যবহার করেননি! অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার না করেও নিরাপদে কম্পিউটার ব্যবহার করতে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতেন। গত বছরের অক্টোবর মাসে তুরস্কগামী একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় জন ম্যাকাফি স্পেনে গ্রেপ্তার হন। বিভিন্ন কনসালট্যান্সি, বক্তৃতা থেকে আয়, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং নিজের জীবন কাহিনির স্বত্ব বিক্রি থেকে বহু কোটি ডলার আয় করার পরও চার বছরের ট্যাক্স রিটার্ন জমা না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ অভিযোগ আনে, ম্যাকাফি বেনামে ব্যাংকে এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ অ্যাকাউন্টে তার আয় জমা রাখার মাধ্যমে কর এড়িয়েছেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বেনামে একটি ইয়ট এবং স্থাবর সম্পত্তিসহ বিভিন্ন সম্পদ গোপন রাখার অভিযোগ ছিল। এ কারণে গত বুধবার স্পেনের উচ্চ আদালত কর ফাঁকির মামলায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের অনুমতি দেয়। এরপর তাকে জেল হেফাজতে রাখা হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু। বাবার পথ ধরেই আত্মহত্যাকে বেছে নিলেন ম্যাকাফি। বিবিসিকে ২০১৩ সালে ম্যাকাফি বলেছিলেন, যখন ম্যাকাফির বয়স ১৫ বছর, তখন তার বাবা গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন!
পৃথিবীর বুকে যতদিন কম্পিউটারের ব্যবহার থাকবে, ততদিন এর ব্যবহারকারীরা ম্যাকাফির কাছে বিশেষভাবে ঋণী থাকবে, ম্যাকাফির যুগান্তকারী অ্যান্টিভাইরাস আবিস্কারের জন্য।