করোনাভাইরাসের একটি নতুন প্রজাতির খবর প্রকাশ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর থেকেই রূপগুলো চিহ্নিতসহ তা তদন্ত করা হয়েছে। নতুন প্রজাতির উপসর্গগুলো জন্ম দেয নানা প্রশ্নের। যেমন এতে কি অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি? কোভিড ১৯ ভ্যাকসিনগুলো কি এখনও কাজ করবে? পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এখনই নতুন বা ভিন্ন কিছু করা উচিত?
জন হপকিন্স মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অনুষদের দুজন অধ্যাপক জানান এই সম্পর্কে। তার কিছু অংশ সচেতনতার জন্য তুলে ধরা হলো।
করোনাভাইরাসের মিউটেশন বা পরিবর্তন: করোনাভাইরাসের মতো আরএনএ ভাইরাসগুলোর প্রকৃতি হলো ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়া এবং পরিবর্তন করা। ভাইরাসের জিনগুলোতে কোনও পরিবর্তন বা রূপান্তর হলে ভাইরাসের মিউটেশন ঘটে। ভৌগলিক পৃথকীকরণের ফলেও জিনগতভাবে পৃথক পৃথক রূপ দেখা যায়। ভাইরাসের মিউটেশন অন্যান্য ভাইরাসেও হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লু ভাইরাসগুলো প্রায়শই পরিবর্তিত হয়, এ কারণেই চিকিত্সকরা প্রতি বছর একটি নতুন ফ্লু ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দেন।
নতুন করোনাভাইরাস প্রজাতি: সারস-কোভি- ২ করোনাভাইরাসটির একাধিক রূপ দেখা গেছে যা চীনে প্রথম শনাক্ত করা সংস্করণ থেকে আলাদা। করোনাভাইরাসটির পরিবর্তিত সংস্করণটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে শনাক্ত করা হয়। এই রূপটি বর্তমানে B.1.1.7 নামে পরিচিত। যুক্তরাজ্যের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই নতুন প্রজাতিটি সবচেয়ে সংক্রামক। ডিসেম্বর মাসে নতুন কোভিড ১৯ কেসের প্রায় ৬০% অংশই এটির কারণে।
এছাড়াও ব্রাজিল, ক্যালিফোর্নিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে একটি নতুন প্রজাতির উত্থান হয়েছে। প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাতে B.1.351.নামে নতুন প্রজাতি দেখা গিয়েছে, এটিতে করোনভাইরাসের পূর্ববর্তী সংস্করণগুলো থেকে আলাদা। ধারণা করা হচ্ছে আগের করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া লোকদের আবারও এই নতুন প্রজাতি সংক্রমিত করতে পারে। বর্তমান করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন নিলে এটি থেকে কিছুটা প্রতিরোধ হতে পারে।
উদ্বেগের কারণ: করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি সম্পর্কে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হলো, এই নতুন প্রজাতির পরিবর্তনগুলো বর্তমান চিকিত্সা এবং প্রতিরোধককে প্রভাবিত করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে চিহ্নিত হওয়া B.1.351 নামের প্রজাতি নিয়ে গবেষণার প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে যে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে প্রাপ্ত কোভিড ১৯ ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাসটির এই সংস্করণকে ‘ন্যূনতম’ সুরক্ষা দেয়।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণের পরে যারা B.1.351 করোনাভাইরাস প্রজাতি দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তারা হালকা বা মাঝারি অসুস্থতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। B.1.351 পরিবর্তিত প্রজাতিটি আগের সংস্করণগুলোর চাইতে কম মাত্রায় অসুস্থ করে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন নতুন রূপে কাজ করবে: গবেষকদের পরীক্ষাগার গবেষণার নতুন প্রমাণ রয়েছে যে, বর্তমান ভ্যাকসিনগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন কিছু স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কম কার্যকর হতে পারে। এই কারণে যারা ভ্যাকসিন পেয়েছেন তাদের তাই আগের সকল নির্দেশনা এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা অব্যাহত রাখা উচিত যেমন মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার স্বাস্থ্যবিধি পালন।
নতুন করোনভাইরাসের রূপগুলো : ইংল্যান্ডের বি .১.১..৭ ভেরিয়েন্টে ১৭টি জিনগত পরিবর্তন রয়েছে। কিছু প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে যে এই রূপটি আরও সংক্রামক। বিজ্ঞানীরা যে জায়গাগুলোতে নতুন স্ট্রেনের উপস্থিতি পেয়েছেন সেখানে সংক্রমণের মাত্রার তীব্রতা লক্ষ করেছেন। বিজ্ঞানীরা নোট করেছেন যে B.1.1.7 সংস্করণে কিছু পরিবর্তন করোনাভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনকে প্রভাবিত করে বলে মনে হয় যা SARS-CoV-2 এর বাহ্যিক আবরণকে আচ্ছাদন করে এবং ভাইরাসটিকে এর বৈশিষ্ট্যযুক্ত চতুষ্পদ চেহারা দেয়। এই প্রোটিনগুলো নাক, ফুসফুস এবং শরীরের অন্যান্য অঞ্চলে কোষগুলোতে ভাইরাস সংযুক্ত করতে সহায়তা করে।
নতুন এই রূপের মধ্যে কিছু পরিবর্তনের কারণে এটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে দ্রুত ছড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সংক্রমণের ফলে আরও বেশি লোক অসুস্থ বা মারা যায়। এছাড়াও, ব্রিটেনের প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে যে, কয়েকটি রূপ আরও গুরুতর রোগের সাথে যুক্ত হতে পারে। অতএব, এই নতুন স্ট্রেইনগুলোর উপর নজর রাখার জন্য জিনগত সিকোয়েন্সিং গবেষণা জরুরি।
নতুন কোভিড ১৯ রূপটি কি শিশুদের পূর্ববর্তী স্ট্রেনের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে?
নতুন স্ট্রেইন প্রাপ্ত অঞ্চলের বিশেষজ্ঞরা তাদের শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক আক্রান্তের কথা বলেছেন। তবে তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বাচ্চারা যেমন পুরানো রূপগুলো দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে, তেমনি নতুনটিও রয়েছে। শিশুদের মধ্যে সংক্রামক বা রোগ সৃষ্টির জন্য নতুন স্ট্রেইনের বিশেষ কোনও প্রবণতা রয়েছে এর কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
গত বছর বিশ্বের ১০৪তম দেশ হিসাবে করোনাভাইরাস মহামারি শিকার হয়েছিলো বাংলাদেশ যার দ্বিতীয় ওয়েভের রেশ এখনো বয়ে চলেছি আমরা। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর মিলেছিল আমাদের দেশে। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে প্রায় নয় হাজারজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমরা চিরতরে হারিয়েছি। অর্থাৎ মৃত্যুহার প্রায় ১.৫%। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পরবর্তী দুইমাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা তিন অংকের মধ্যে থাকলেও তা বাড়তে বাড়তে গত বছরের জুলাইতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। গত বছর ২ জুলাই সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। আশঙ্কার কথা এই যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা গত বছরের জুলাই মাসের পর থেকে কমে এলেও এই বছরের মার্চ মাস থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে।
সচেতনতাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এজন্য সবাইকে সবসময় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভালো করে সাবান-পানি অথবা এলকোহল বেসড হ্যান্ডরাব অর্থাৎ ৭০% ইথানল বা আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল বিশিষ্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। তাই হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ ঘষা থেকেও বিরত থাকতে হবে। করোনাভাইরাস কেবলমাত্র নাক, মুখ ও চোখের উন্মুক্ত শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়েই দেহে প্রবেশ করতে পারে। যথাযথ ব্যবস্থা ছাড়া সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকেও বিরত থাকতে হবে। অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকিকাল পার হওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। পাশাপশি বর্তমানের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ থেকে এড়াতে চাইলে আরো কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।